আজ ২৭শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পরশুরামের ঐতিহ্যবাহী উত্তর গুথুমা-বেড়াবাড়িয়া গ্রামের ইতিহাস

আজাদ মজুমদার: মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীর আঞ্চলিক অপারেশন হেড কোয়ার্টার ছিল বেড়াবাড়িয়ার আলী আহমেদ মজুমদার এর বাড়িতে। বেড়াবাড়িয়ার দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল বিহারী টাইগার ( পাটনার টাইগার)।

বেড়াবাড়িয়া পরশুরামের একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম।ভারত পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর এখানে সর্বপ্রথম বসবাস শুরু করেন জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিন মজুমদারের ছোট দুই ছেলে আলহাজ্ব মাষ্টার আলী আহমেদ মজুমদার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সামছুল হুদা মজুমদারের পরিবার। জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিন মজুমদারের স্ত্রী তার দুই ছেলেকে নিয়ে সর্বপ্রথম গুথুমা বেড়াবাড়িয়া নামক গ্রামে বসবাস শুরু করেন। হাজী তমিজ উদ্দিন মজুমদারের ছেলে আলহাজ্ব মাষ্টার আলী আহমেদ মজুমদার তার মামা বদিউর রহমান চৌধুরী কে স্থানান্তরের মাধ্যমে এই এলাকায় নিয়ে আসেন। তাদের সাথে জনাব আব্দুর রশিদ চৌধুরীর পরিবারও বসবাস শুরু করেন।

আলহাজ্ব মাষ্টার আলী আহমেদ মজুমদার এর পিতা জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিন মজুমদার ১৮৯৮ সালে জন্ম গ্রহণ করেন এবং তিনি ১৯২৬ সালে জাহাজযোগে প্রথম হজ্জ আদায় করেন। গুটিকয়েক ব্যক্তি যারা ঐ সময়ে এতোটা দূরদূরান্তে থেকে সুদূর সৌদি আরবের মক্কা মদিনায় গিয়ে হজ্জ পালন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিন মজুমদার তাদের একজন ছিলেন। অঢেল ধন সম্পদের মালিক হওয়ার কারনে জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিন মজুমদারের পক্ষে তা করা সম্ভব হয়েছিল। ১৯২৮ সালে উত্তর বিলোনিয়া শহরের তাকিয়ার পাশে তিনি বসবাস করতেন। অঢেল ধনসম্পত্তির মালিক হিসেবে এলাকায় তার ব্যাপক সুখ্যাতি ছিল।

জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিন মজুমদার তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত খেতাব “আড্ডাদার” উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের প্রতিবাদস্বরূপ উত্তর বিলোনিয়ার তার অঢেল ধন সম্পত্তির খাজনা ব্রিটিশদের দিতে অস্বীকার করায় ব্রিটিশরা চারজন সৈনিক পাঠায় তাকে গ্রেফতার করার জন্যে। তিনি তার বিশ্বস্ত লোকজনদের সাথে নিয়ে সুকৌশলে ব্রিটিশ সরকারের সৈন্যদের পিটিয়ে তার জমিদারি থেকে বের করে দেন। তার এই কর্মকাণ্ড তখন এলাকায় ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।

উল্লেখ্য, উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশদের উৎখাত ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিন মজুমদারদের মতো ব্যক্তিরা নিজেদের অবস্থানে থেকে সবসময় জীবনবাজী রেখে কাজ করে যেতেন।
পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকারের রোষানল থেকে বাঁচার জন্যে জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিন মজুমদার বর্তমান মধুগ্রাম সত্যনগরের পশ্চিমে গভীর জংগলের পশ্চিমের পাহাড় নামে পরিচিত বর্তমানে যেটা ভারতের অংশ সেখানে আত্বগোপন করে ছিলেন দীর্ঘ ছয়টি বছর। তারপরও তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের সম্পূর্ণ অবৈধ কর্মকাণ্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেন নি। অবশেষে ১৯৩৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিরা তার সাথে সমঝোতা করতে বাধ্য হয় এবং তিনি উত্তর বিলোনিয়ায় সগৌরবে ফিরে আসেন।

জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিন মজুমদার ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বারের মতো পবিত্র হজ্জব্রত পালন করেন। ভারত পাকিস্তান ভাগের পর তিনি তার বড় ছেলেকে সম্পত্তির কিছু অংশ কাউতলীর বটতলী বাজারে, সম্পত্তির কিছু অংশ ফুলগাজীর বাসুরায় ও বাসুরার দীঘিসহ স্থানান্তর করেন। পরবর্তীতে বাসুরার দীঘি প্রভাবশালী মহল দখল করে নেয়। সম্পত্তির কিছু অংশ তিনি বেড়াবাড়িয়া নামক গ্রামে স্থানান্তর করেন। তবে তিনি তার সম্পত্তির নব্বই শতাংশই স্থানান্তর করতে পারেন নি, যার সম্পত্তির উপর এখন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো রাষ্ট্রীয় স্থাপনা গড়ে উঠেছে। জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিন মজুমদার এর বিলোনিয়া শহরের শতাধিক একর জায়গা হিন্দুরা এখন ভোগদখল করছে। উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সালে ভারত সরকার জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিন মজুমদার এর মালিকানাধীন জায়গা ব্যবহার করে মহাসড়ক ও রাষ্ট্রীয় স্থাপনা নির্মাণ এর কারণে তৎকালীন সময়ে এক লক্ষ রুপি বরাদ্দ করেন তার নামে। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এ) বসবাসের কারনে সেই টাকা উত্তোলন করতে পারেন নি। ঐ সময়ের এক লক্ষ টাকার মার্কেট ভেলু বর্তমানের কত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিন মজুমদার এর বড় ছেলে বটতলীতে বসবাস করেন। ছোট দুই ছেলে আলহাজ্ব মাস্টার আলী আহমেদ মজুমদার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সামছুল হুদা মজুমদার বেড়াবাড়িয়ায় এসে বসবাস শুরু করেন । দেশ ভাগের পর ১৯৪৮ সালে হিন্দু ও মুসলমান সহ কিছু জনগোষ্ঠী বেড়াবাড়িয়া ত্যাগ করে চলে যায়।

কথিত আছে উত্তর গুথুমার বেড়াবাড়িয়া গ্রামের “বেড়াবাড়িয়ার দিঘী” মগ রাজারা ১৬০০ শতকে খনন করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, বেড়াবাড়িয়ার দীঘির পাড়ে স্বর্ণালংকার ও মনি মুক্তা লুকায়িত আছে। মগরা স্বাধীনতার পর অনেক বার ভারত থেকে এসে দীঘির পাড় গোপনে খনন করতো। দীঘির পাড়ে তিনটি বড় বড় বটগাছ ছিল। এখানে ব্রিটিশ আমলে প্রতি বছর মেলা বসত। তাই উত্তর গুথুমার “বেড়াবাড়িয়া” গ্রামকে একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

বেড়াবাড়িয়া গ্রামে কোনো রাস্তা ছিল না, ছিল শুধু জমির আইল। এই গ্রামের আদি বাসিন্দা আলহাজ্ব মাস্টার আলী আহমেদ মজুমদার আব্দুর রশিদ চৌধুরীকে সাথে নিয়ে রাস্তার ব্যবস্থা করেন। কিন্ত প্রথমে তারা কিছু জমির মালিকদের তীব্র বাঁধার সম্মুখীন হন। কিছু জমির মালিকরা কোলাপাড়া থেকে লাঠিয়াল বাহিনী এনে রামদা কিরিচ নিয়ে হামলা করার চেষ্টা করেন আলী আহমেদ মাস্টার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপর। সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে করা এমন হামলা থেকে বাঁচার জন্যে জনাব আলহাজ্ব মাষ্টার আলী আহমেদ মজুমদার ও আব্দুর রশিদ চৌধুরী ঐতিহ্যবাহী ফেনীর পরশুরামের গুথুমা চৌধুরী বাড়িতে আশ্রয় নেন। উল্লেখ্য, জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিন মজুমদারের ছোট ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব সামছুল হুদা মজুমদার উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী ফেনীর পরশুরামের গুথুমা চৌধুরী বাড়ির মেয়ে বিয়ে করেন। এর মাধ্যমে গুথুমা চৌধুরী বাড়ির সাথে জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিনের পরিবারের মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। মাস্টার আলী আহমেদ মজুমদার আরেক ঐতিহ্যবাহী পরিবার বাসপদুয়ার ঐতিহ্যবাহী “মজুমদার বাড়ি”র আলহাজ্ব আসাদুজ্জামান মজুমদার এর ( ছানু মাষ্টার) এর মেয়ে বিয়ে করেন।যিনি ১৯১৮ সালে ইন্টারইমিডিয়েট পাশ করেন। তঁার ছোট ভাই অধ্যক্ষ আলী আজম মজুমদারের এম এস সি যিনি পাকিস্তান সরকারের সচিব ছিলেন।আলহাজ্ব আসাদূজ্জমান মজুমদারের ইতিহাস পরবর্তীতে জানানো হবে।
বড় ছেলে আলী আকবর মজুমদার
অলকা মজুমদার বাড়িতে বিবাহ করেন। যিনি তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবালের ফুফাতো বোন।

জনাব মাষ্টার আলী আহমেদ মজুমদার তখন তার ছোট ভাই জনাব সামছুল হুদা মজুমদার এর শ্বশুর বাড়ি উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী ফেনীর পরশুরামের গুথুমা চৌধুরী বাড়ির জনপ্রিয় সমাজ সেবক ও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব জনাব আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম এর নানা ও তার ছোট ভাই জনাব জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী পাপ্পু,র দাদা শ্বশুর জনাব হোচ্ছাম হায়দার চৌধুরী ওরফে কালাচাঁন চৌধুরী ওরফে কালাচাঁন মেম্বার ও ভাষানী মেম্বারকে বিষয়টি অবগত করেন। তারা প্রত্যক্ষভাবে এলাকায় তিনদিন উপস্থিত থেকে রাস্তা নির্মাণের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্ত তারপরও আবার বাঁধা আসলে মাষ্টার আলী আহমেদ মজুমদার ও আরেকজন ব্যক্তি রাস্তার জায়গা ক্রয় করে নেন। ক্রয়কৃত জায়গার প্রদানকৃত টাকার বেশি অংশ মাষ্টার আলী আহমেদ মজুমদার একাই বহন করেন। যেহেতু তিনি চাকুরীজীবি ছিলেন, তাই টাকার অংক বহনকরা তার পক্ষে তেমন সমস্যা ছিল না। আব্দুর রশিদ চৌধুরী বাকি অংশ বহন করেন।

পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় পর আশির দশকে এসে সামান্য একটু যায়গা কিনে আরও দুটি পরিবার এখানে বসবাস করা শুরু করেন। মাষ্টার আলী আহমেদ মজুমদাররা চেয়েছিলেন আরও কিছু পরিবার তাদের সাথে একসাথে এখানে এসে বসবাস করুক। তাই তারা নিজেরা রাস্তার পাশের সব জায়গা একাই না কিনে অন্যদেরকেও কিছু জায়গা কেনার সুযোগ করে দেন। যারা পরবর্তীতে এসে সামান্য কিছু জায়গা কিনে বসতবাড়ি গড়ে তোলেন তাদের চলাফেরার জন্যে তেমন যায়গা না থাকাতে, মাস্টার আলী আহমেদ মজুমদার মানবিকতা দেখিয়ে তাদেরকে তার পারিবারিক জায়গা জমি ব্যবহার করার সুযোগ দেন। এখনো পর্যন্ত তারা মাস্টার আলী আহমেদ মজুমদার ও তার ছোট ভাই সামছুল হুদা মজুমদারের মালিকানাধীন কিছু জায়গা জমি বিভিন্নভাবে বিনামূল্যে ব্যবহার করে যাচ্ছেন। বর্তমানে আরও বেশ কিছু পরিবার জমি কিনে উত্তর গুথুমা বেড়া বাড়িয়া গ্রামে বসতি স্থাপন শুরু করেন।

জমিদার হাজী তমিজ উদ্দিনের ছেলে মেয়ে, নাতি নাতনিরা সবাই উচ্চ শিক্ষায় সুশিক্ষিত। তার বংশধরদের হাতে নতুনভাবে গোড়াপত্তন হওয়া ফেনীর পরশুরামের উত্তর গুথুমা ঐতিহ্যবাহী “বেড়াবাড়িয়া” গ্রাম এখন দ্রুতগতিতে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠছে। দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ এসে এখন বেড়াবাড়িয়াতে নতুন করে বসতি স্থাপন করছেন। টিকে থাকুক অনাদিকাল পর্যন্ত “বেড়াবাড়িয়া” নাম ও গ্রামটি।

     এই ক্যাটাগরির অন্যান্য নিউজ